হলুদের স্বাস্থ্য উপকারিতা

  

 ঔষধি গাছের ব্যবহার পদ্ধতি  Method of use of medicinal plants


হলুদ


সেইসঙ্গে প্রদাহ ও অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমিয়ে ইনসুলিন প্রতিরোধ এবং স্থূলত্বের মতো স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো দূরে রাখতে কাজ করে। অস্টিওআর্থারাইটিস এবং রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী জয়েন্টের ব্যথার অবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে হলুদ। এতে থাকা কারকিউমিন ব্যথা উপশম এবং জয়েন্টের উন্নতি করে।

কাঁচা হলুদের গুণ

  • ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য কাঁচা হলুদ বিশেষ উপকারী। এটি রক্তে শর্করার মাত্রা ঠিক রাখতে সহায়তা করে। 
    কাঁচা হলুদ আমাদের হজমশক্তি বাড়িয়ে দেয়। ফলে সহজেই খাবার পরিপাক হতে সাহায্য করে।
    যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের এক গবেষণায় দেখা গেছে, কাঁচা হলুদে অনেক আয়রন থাকে। শরীরে আয়রনের স্বল্পতা দেখা দিলে এটি আয়রন বাড়াতেও সহায়তায় করে।
    ২০১৭ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কারকিউমিন এলডিএল ও টোটাল কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করে। আর এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরল হ্রাস করা মানে হলো আমাদের শরীরে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমানো, যার সঙ্গে কমে স্ট্রোকের ঝুঁকিও।
    হলুদ চা ক্যানসার প্রতিরোধে অবদান রাখতে পারে। কারকিউমিনকে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট একটি কার্যকর অ্যান্টিকার্সিনোজেন পদার্থ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়তা করে।
    আলসারেটিভ কোলাইটিস (ইউসি) একটি দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা, যা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাক্টের (জিআই ট্র্যাক্ট) নিচের অংশে আলসার সৃষ্টি করে। কাঁচা হলুদ এই রোগ দানা বাঁধতে বাধা দেয়। ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড মেডিকেল সেন্টার বলছে, ইউসি রোগীরা হলুদ খেলে তাঁদের এই রোগ আবার হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।



  • কাঁচা হলুদ ভালো কেন

    • কাঁচা হলুদের সক্রিয় উপাদান হলো কারকিউমিন নামে একটি প্রাকৃতিক যৌগ (পলিফেনল), যার অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি—দুটি বৈশিষ্ট্যই আছে। যা বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে খাদ্যনালিকে সুরক্ষিত রাখে।
      অন্যান্য রঙিন উদ্ভিদভিত্তিক খাবারের মতো কাঁচা হলুদ ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট-সমৃদ্ধ, যা বিনা মূল্যে র‍্যাডিক্যাল-নিরপেক্ষ (যথা দূষণ, সূর্যালোক) এবং আমাদের কোষগুলোকে ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষা করে।
      এটা ক্যানসার ও হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধ করতে পারে।
      খাবারে কিছু কাঁচা হলুদ ব্যবহার করলে দেহের অভ্যন্তরের প্রদাহ দূর হয়।
      বাতব্যথা ও জয়েন্টে ব্যথা, কোলাইটিস, অ্যালার্জি ও সংক্রমণের মতো প্রদাহ ভালো করতে পারে কাঁচা হলুদ।


    কাঁচা হলুদ চা কীভাবে বানাবেন

    আদার মতো হলুদের মূল দিয়ে পুষ্টিকর ও সুস্বাদু চা তৈরি যায়। জনস হপকিনস মেডিসিনের একজন অনকোলজি বিশেষজ্ঞ, ক্লিনিক্যাল ডায়েটিশিয়ান ও পুষ্টিবিদ, মেরি-ইভ ব্রাউন কাঁচা হলুদের প্রস্তুত প্রণালি দিয়েছেন এভাবে—
    ২ টেবিল চামচ কাঁচা হলুদের কাটা মূল বা ২ চা-চামচ হলুদগুঁড়া।
    ১-২ কাপ পানিতে ফুটিয়ে নিন।
    কম আঁচে ৫ মিনিট সেদ্ধ করুন। তারপর ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে নিন। এরপর স্বাদ পরিবর্তন করতে লেবু ও মধু যোগ করুন। ব্যস, হয়ে গেল কাঁচা হলুদের চা। এই চা আপনি গরম ও ঠান্ডা—দুইভাবে খেতে পারেন।


রোগ সারাতে হলুদের ব্যবহৃত

আদিকাল থেকে আমরা হলুদের নানা ধরনের ব্যবহার দেখে আসছি—রূপচর্চা, রান্না, ব্যথা নিবারণ ইত্যাদিতে। তবে ঔষধিগুণের কারণে ওষুধ হিসেবেও এর ব্যবহার হয়ে আসছে। হলুদে আছে কিছু বিশেষ উপাদান, যা শরীরের অনেক সমস্যার কার্যকরী সমাধান। হলুদে অ্যান্টি–ইনফ্লামেশন, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট, অ্যান্টিসেপটিক, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও কার্কুমিন উপাদান আছে, যা আমাদের শরীরের অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে, বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন এমন রোগের ক্ষেত্রে।  

হলুদে তিনটি উল্লেখযোগ্য উপাদান হলো কার্কিউমিন, ডেমথক্সাইকুরকুমিন এবং বিসডেমেথক্সাইকুরকুমিন। এর মধ্যে কার্কিউমিন হলো স্বাস্থ্যের পক্ষে সর্বাধিক সক্রিয় এবং সবচেয়ে উপকারী যার বিশ্বাসযোগ্য উৎস হলো হলুদ। বেশির ভাগ হলুদে প্রায় ২-৮ শতাংশ প্রতিনিধিত্বকারী কার্কুমিন হলুদকে তার স্বতন্ত্র রং এবং স্বাদ দেয়; কার্কিউমিন তার প্রদাহবিরোধী, অ্যান্টিটিউমার এবং অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট প্রভাবগুলোর জন্য পরিচিত।

এগুলো আমরা নানাভাবে আমাদের প্রয়োজনে স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু কীভাবে সেটা সম্ভব, তা জানিয়ে দেওয়া হলো:


ক্যানসার প্রতিরোধে

নিয়মিত হলুদের গুঁড়া খেলে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়; বিশেষ করে ক্যানসার প্রতিরোধ করে। ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি এবং ছড়িয়ে পড়া রোধে হলুদ সাহায্য করে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এটি মুখগহ্বরের ক্যানসার রোধে খুবই কার্যকরী।

শ্বাসজনিত সমস্যা
যাঁদের অ্যাজমা ছাড়াও শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে, তাঁদের জন্য হলুদের গুঁড়া অত্যন্ত উপকারী; নিয়মিত হলুদগুঁড়া গরম পানির সঙ্গে মিশিয়ে প্রতিদিন রাতে শোয়ার আগে খেলে শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।


লিভারের ইনফেকশন

লিভারের ইনফেকশন আছে, জন্ডিস হয়ে থাকলে প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে এক কাপ গরম পানির সঙ্গে এক চা–চামচ হলুদগুঁড়া মিশিয়ে খেলে লিভারের ইনফেকশন কমে যায়, এই চিকিৎসা দীর্ঘ মেয়াদে করতে হয়। আবার সকালে খালি পেটে দুই চা–চামচ কাঁচা হলুদের রস খেলে লিভারে বাইলের উৎপাদন বেড়ে যায়। এই বাইলই শরীর থেকে বিষ, বর্জ্য নির্মূল করতে ভূমিকা পালন করে। এই বাইল দেহ থেকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোলেস্টেরল বের করে দেয় এবং পাকস্থলী থেকে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে।


টক্সিন মুক্ত করতে

যদি শরীর অসুস্থ হয়ে যায় অথবা নানা রকম রোগের উপসর্গ দেখা দেয়, তবে দেহকে সম্পূর্ণ টক্সিনমুক্ত করলে সব রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে প্রতিদিন সকালে এবং রাতে হলুদগুঁড়া এক কাপ গরম পানিতে মিশিয়ে খেতে হবে।


শিশুদের লিউকেমিয়া সারায়
শিশুদের লিউকেমিয়া এখন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে, শিশুদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, বিশেষত অ্যান্টিবায়োটিক নিয়মিত খাওয়ার ফলে শিশু অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য অ্যান্টিবায়োটিকে আর কাজ হচ্ছে না। এমন শিশুদের জন্য কাঁচা হলুদের রস এক চা–চামচ কুসুম গরম পানি ও মধু মিশিয়ে খেতে হবে, দীর্ঘ মেয়াদে কাঁচা হলুদ খেলে লিউকেমিয়া সেরে যায়।


ক্রনিক ইনফ্ল্যামেশন বা দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ দূর করে
কম সময়ের প্রদাহ শরীরের জন্য উপকারী এবং এটি রোগের সঙ্গে লড়াই করে। তবে দীর্ঘ সময়ের প্রদাহ বা ক্রনিক ইনফ্ল্যামেশন জীবননাশের কারণও হয়। হলুদ এই দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ দূর করতে সাহায্য করে। সকালে কাঁচা হলুদের রস এক চা–চামচ কুসুম গরম পানির সঙ্গে মিশিয়ে খাবেন এবং রাতে হলুদের গুঁড়া গরম পানির সঙ্গে মিশিয়ে খেলে ক্রনিক ইনফ্ল্যামেশন দূর হয়ে যায়।
BDNF (Brain-derived neurotrophic factor) হরমোন অথবা ব্রেন-ডিরাইভড নিউরোট্রোপি মস্তিষ্কে নিউরনের ভাগ এবং সংখ্যা বৃদ্ধিতে কাজ করে, যা মস্তিষ্কের রোগের ঝুঁকি কমায়। বয়স বাড়লে মস্তিষ্কের এই কার্যকারিতা কমে যায়। যদি খাদ্যতালিকায় হলুদ থাকে, এই হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায়। এটি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে কাজ করে, স্মৃতিশক্তি এবং বুদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করে, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ায়। সকালে কাঁচা হলুদের রস এক চা–চামচ কুসুম গরম পানির সঙ্গে মিশিয়ে খাবেন এবং রাতে হলুদের গুঁড়া গরম পানির সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হবে।

হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমায়
রক্তনালির অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হলে রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত হয়, এতে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ে। খাদ্যতালিকায় হলুদ থাকলে রক্তনালির কার্যক্রম ভালো থাকে। এর ফলে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমে। সকালে কাঁচা হলুদের রস এক চা–চামচ কুসুম গরম পানির সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হবে এবং রাতে হলুদের গুঁড়া গরম পানির সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হবে।
হলুদের গুণ পেতে হলে অবশ্যই গুঁড়ার ক্ষেত্রে প্যাকেটজাত হলুদ না নিয়ে খোলা হলুদ কিনে নিজেই পিষে নিন, তাতে ভালো ফল পাওয়া যাবে। কাঁচা হলুদের ক্ষেত্রে ফ্রিজে না রেখে পেস্ট করতে পারলে ভালো। আর যদি অর্গানিক হলুদ পাওয়া যায়, সেটায় ভালো ফল পাওয়া যাবে। হলুদ ঔষধিগুণে ভরা; এর নির্দিষ্ট ডোজ আছে তাই অতিরিক্ত খেলে পেটের সমস্যা তৈরি হয়। এ জন্য অতিরিক্ত না খেয়ে বর্ণিত ডোজে খাওয়া উত্তম।
অনেকে হলুদ গায়ে মাখেন, এটা আয়ুবের্দিক মতে বহুগুণের, বিশেষ করে শরীরে কোনো ধরনের শুষ্ক চর্মরোগ থেকে থাকে তার জন্য ভালো। সপ্তাহে দুই দিন গায়ে মাখলেই যথেষ্ট।


অতিরিক্ত হলুদ খেলে কী হয়?

হলুদ এবং কারকিউমিন সাধারণত নিরাপদ। তবে এর সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যখন অতিরিক্ত মাত্রায় খাওয়া হয় বা পরিপূরক হিসাবে নেওয়া হয়। চলুন জেনে নেওয়া যাক, অতিরিক্ত হলুদ খাওয়ার অপকারিতা সম্পর্কে-

১. পেট খারাপ:

হলুদ বা কারকিউমিনের উচ্চ মাত্রায় পেট খারাপ, অ্যাসিড রিফ্লাক্স এবং ডায়রিয়া সহ গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল অস্বস্তি হতে পারে।

২. মাথাব্যথা এবং মাথা ঘোরা
কারকিউমিন ৪৫০ মিলিগ্রাম বা তার বেশি মাত্রায় খেলে কারও কারও ক্ষেত্রে মাথাব্যথা এবং মাথা ঘোরার সমস্যা হতে পারে।

৩. পেটের সমস্যা:
 হলুদ পেটের সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে, যেমন অ্যাসিড রিফ্লাক্স এবং পিত্তথলির পাথর।


৪. গর্ভাবস্থা এবং বুকের দুধ খাওয়ানোর ক্ষেত্রে: 
গর্ভবতী এবং বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন এমন নারীদের ক্ষেত্রে হলুদের সাপ্লিমেন্ট এড়ানো উচিত, কারণ এটি জরায়ু সংকোচনকে উদ্দীপিত করতে পারে। ফলে দেখা দিতে পারে জটিলতা।

কাঁচা হলুদ খাওয়ার আগে সাবধানতা

  • ব্যথা উপশমকারী ইন্ডোমেথাসিন, অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন বা অ্যাসিটামিনোফেনের প্রভাব কমাতে পারে হলুদের ক্যাপসুল (হলুদের সাপ্লিমেন্ট)।

  • কেউ যদি কেমোথেরাপি চিকিৎসা নিতে থাকেন, তাহলে কাঁচা হলুদের ক্যাপসুল বা ট্যাবলেট গ্রহণ করার আগে আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন।

  • যাঁরা ওয়ারফারিন গ্রহণ করছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে হলুদ ক্যাপসুল রক্ত পাতলা করে ঝুঁকি বাড়াতে পারে (হলুদের সাপ্লিমেন্ট)।

  • ইমিউনোসপ্রেসিভ ওষুধ যাঁরা গ্রহণ করেন, তাঁরা যদি বেশি কারকিউমিন সেবন করেন, তবে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।


Post a Comment

Previous Post Next Post