আমলকি (চিকিৎসায় আমলকির ব্যবহার)

আমলকি (চিকিৎসায় আমলকির ব্যবহার)



আমলকী (বৈজ্ঞানিক নাম: Phyllanthus emblica) ফাইলান্থাসি পরিবারের ফাইলান্থুস গণের একপ্রকার ভেষজ ফল।] সংস্কৃত ভাষায় এর নাম 'আমলক'। ইংরেজি নাম amla বা Indian gooseberry , Malacca tree, emblic myrobalan , বা emblic ,myrobalanএরা রোমশ বিহীন বা রোমশ পর্ণমোচী বৃক্ষ।

ঔষধি গুণ

আমলকী কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের উপর কাজ করে।
বমি বন্ধে কাজ করে।
দীর্ঘমেয়াদি কাশি সর্দি হতে উপকার পাওয়ার জন্য আমলকীর নির্যাস উপকারী।
এটি হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্কের শক্তিবর্ধক।
এটি দাঁত,চুল ও ত্বক ভাল রাখে।
এটি খাওয়ার রুচি বাড়ায়।
কোষ্ঠকাঠিন্য, মাথাব্যথা, অম্ল,রক্তশূন্যতা, বমিভাব দূর করতে সাহায্য করে।

আমলকী গাছ ৮ থেকে ১৮ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট হতে পারে, পাতা ঝরা প্রকৃতির। হালকা সবুজ পাতা, যৌগিক পত্রের পত্রক ছোট, ১/২ ইঞ্চি লম্বা হয়। হালকা সবুজ স্ত্রী ও পুরুষফুল একই গাছে ধরে। ফল হালকা সবুজ বা হলুদ ও গোলাকৃতি ব্যাস ১/২ ইঞ্চির কম বেশি হয়। কাঠ অণুজ্জল লাল বা বাদামি লাল। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলে ই দেখা যায়। গাছ ৪/৫ বছর বয়সে ফল দেয়। আগস্ট - নভেম্বর পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। বীজ দিয়ে আমলকীর বংশবিস্তার হয়। বর্ষাকালে চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়।




আমলকির পুষ্টিগুণঃ

আমলকির অনেক ভেষজ গুণ রয়েছে। এই গাছের ফল ও পাতা দুটিই ওষুধরূপে ব্যবহার করা যায়। আমলকিতে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’ থাকে যা পেয়ারার চেয়ে ৩ গুণ ও কাগজি লেবুর চেয়ে ১০ গুণ, কমলার চেয়ে ১৫ থেকে ২০ গুণ, আপেলের চেয়ে ১২০ গুণ, আমের চেয়ে ২৪ গুণ এবং কলার চেয়ে ৬০ গুণ বেশি। একজন পুর্ণ বয়স্ক মানুষের জন্য প্রতিদিন ৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ দরকার। কেউ যদি দিনে দুটো আমলকি খায় তাহলে সে ঐ পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’ পেতে পারে। আমলকি খেলে মুখে রুচিও বাড়ে।

 


আমলকির বিভিন্ন ওষধি গুনাগুণ:

১। দাঁতের মাড়ি রোগ স্কার্ভি দূরীকরণে

স্কার্ভি দাঁতের মাঢ়ির খুব পরিচিত একটি রোগ। সাধারণত শরীরে ভিটামিন ‘সি’-এর অভাবে স্কার্ভি রোগ হয়। এ রোগ হলে দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়া, মাড়িতে ঘা হওয়া, শরীর দুর্বল হয়ে যাওয়া, চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণ হওয়া, চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যায় এবং হাড়ের মধ্যে পরিবর্তন দেখা দেয়। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি। তাই কেউ যদি  প্রতিদিন মাত্র ১-২টি আমলকি খায় তাহলে সে এসব থেকে পরিত্রান পেতে পারে।


২। আলসার চিকিৎসায় 

গ্যাস্ট্রিক বা আলসার নামটির সাথে পরিচিত নন এমন লোক খুঁজে বের করা খুব কঠিন। সাধারণত লোকজন গ্যাস্ট্রিক বা আলসার বলতে যা বুঝিয়ে থাকেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় তাকে বলে পেপটিক আলসার। নিয়মিত আমলকি খেলে পেটের এই আলসার দূর হয়।


৩। কোষ্ঠকাঠিন্য  পাইলস চিকিৎসায় 

আমলকীতে সলিউবল ফাইবার থাকে। এটি শরীর থেকে টক্সিক উপাদান বের করে দিতে সাহায্য করে এবং হজমে সাহায্য করে। এর রস কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং পাইলস রোগ থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে।


৪। ক্ষুধামন্দা দূর করতে আমলকি 

প্রতিবার খাওয়ার আগে মাখন ও মধুর সঙ্গে আমলকির গুঁড়া মিশিয়ে খেলে ক্ষুধামন্দা দূর হয়।


৫। দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে

আমলকিতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন এ রয়েছে। তাই দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধিতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে ফলটি। এছাড়া চোখ লাল হওয়া, চুলকানো ও চোখ দিয়ে পানি পড়া রোধেও এটি বিশেষ ভূমিকা রাখে। আমলকির রসের সাথে মধু মিশিয়ে পান করলে তা চোখের জ্যোতি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।


৬। গলা ব্যথা এবং ঠান্ডা দূর করতে

আমলকির গুঁড়োর সাথে মধু মিশিয়ে দিনে ৩-৪ বার খেলে তা গলা ব্যথা এবং ঠান্ডা দূর করতে সাহায্য করে। দীর্ঘমেয়াদী কাশি-সর্দির জন্য আমলকির নির্যাস উপকারী।


৭। হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে

উচ্চ কোলেস্টেরলের মাত্রা হৃদরোগের ঝুঁকিকে অনেক বৃদ্ধি করে দেয়। আমলকি খেলে তা খারাপ কোলেস্টেরল দূর করে ধমনীর ব্লক খুলে দিতে সাহায্য করে। নিয়মিত আমলকি খাওয়া হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে থাকে।


৮। রক্তের সুগার কমাতে

গবেষণায় দেখা গেছে যে, আমলকিতে পলিফেনল রয়েছে যা রক্তে অক্সিডেটিভ শর্করা থেকে শরীর রক্ষা করে। এটি শরীরে ইনসুলিন শুষে নিতে সাহায্য করে যা ডায়াবেটিস কমাতে সাহায্য করে।


৯। দেহের চর্বি কমাতে

ওজন হ্রাস করতে আমলকি সাহায্য নিতে পারেন। এটি নিয়মিত খেলে শরীরের প্রোটিনের স্তর বৃদ্ধি করে, যা দেহের চর্বি কাটতে সাহায্য করে। এটি খেলে হজম শক্তি বেড়ে যায়। ফলে মানুষ মুটিয়ে যায় না। তাই ওজন কমাতে চাইলে প্রতিদিন আমলকি খাওয়ার চেষ্টা করুন।


১০। হাড় মজবুত করতে

আমলকিতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম রয়েছে। যা হাড় মজবুত করতে সাহায্য করে।


১১। রক্ত পরিষ্কার করতে

রক্ত পরিষ্কার করতে আমলকি বেশ কার্যকর। এর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপাদান যা শরীর থেকে টক্সিন উপাদান সব দূর করে দেয়। নিয়মিত আমলকি খেলে তা রক্তে হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধি করে।


১২। চুলের যত্নে ও খুশকির সমস্যা দূর করতে 

আমলকি চুলের টনিক হিসেবে কাজ করে। চুলের যত্ন নেওয়ার জন্য এটি একটি অপরিহার্য উপাদান। আমলকি খেলে শুধু চুলের গোড়াই শক্ত হয় না, চুল দ্রুত বেড়ে ওঠে। চুলকে খুশকিমুক্ত ও কম বয়সে চুল পাকা রোধে আমলকি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন সকালে মধুর সঙ্গে আমলকির রস মিশিয়ে খেলে চর্মরোগ নিরাময় হয়। তাছাড়া এটি খেলে ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায় এবং মুখের চামড়ায় কোনো দাগ পড়ে না।



সকালে খালি পেটে আমলকি খেলে সারবে যেসব রোগ



একটি মাঝারি আকারের কমলার চেয়েও ছোট্ট একটি আমলকিতে বেশি পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে। এমনকি ডালিমের চেয়ে ১৭ গুণ বেশি অ্যান্টি-অক্সিডেসন্ট আছে- এমনই মত বিজ্ঞানীদের। হাজারো পুষ্টিগুণে ভরপুর এই ফল হজমশক্তি বাড়ানো থেকে শুরু করে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দূর করে।

আয়ুর্বেদ মতে, ডায়াবেটিস ও ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণেও কার্যকরী আমলকি। এক আমলকির আছে হাজারো গুণ। বার্ধক্য প্রতিরোধে, চুল ঘন ও লম্বা করতে এমনকি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও সহায়তা করে এটি। আমলকি অন্যতম টনিক। ত্বক উজ্জ্বল করে, রক্তকে বিশুদ্ধ করতে এবং চোখের দৃষ্টিও উন্নত করতে সহায়তা করে।

আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুযায়ী, খালি পেটে আমলকি খেলে বেশ কিছু রোগ থেকে মুক্তি মেলে। কাঁচা, আমলকির চাটনি বা মিছরিও খেতে পারেন। তবে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে একটি করে কাঁচা আমলকি খেলেই রক্ষা পাবেন কঠিন সব রোগ-ব্যাধি থেকে। জেনে নিন যেসব রোগ থেকে বাঁচবেন নিয়মিত আমলকি খেলে।

সর্দি-কাশি প্রতিরোধে:
 আমলকিতে থাকা ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এর ফলে বিভিন্ন ভাইরাল সংক্রমণ থেকে রক্ষা মেলে। সর্দি-কাশির সমস্যা থেকে বাঁচতে দিনে দুই চা চামচ আমলকির গুঁড়ো সামান্য মধুর সঙ্গে মিশিয়ে ৩-৪ বার পান করুন। দেখবেন, দ্রুত স্বস্তি মিলবে।

দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়: 
গবেষণায় দেখা গেছে, আমলকির ক্যারোটিন দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে। প্রতিদিন আমলকি খেলে চোখের ছানির সমস্যা বা চোখের ফোলাভাব দূর করে। পাশাপাশি লালচে চোখ, চুলকানি এবং চোখ দিয়ে পানি পড়ার সমস্যায় কমায়।

মেদ কমায়: 
ওজন নিয়ন্ত্রণে আমলকি খুবই কার্যকরী। আমলকি নিয়মিত সেবনকারীদের অনেকরই মত, খাওয়ার আগে এক গ্লাস পানিতে আমলার গুঁড়ো বা রস মিশিয়ে পান করলে পেট ভরে যায় এবং কম খাওয়া হয়। এর ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।

পুষ্টিবিদরা বলছেন, আমলকি বিপাককেও বাড়িয়ে তোলে। যার ফলে অতিরিক্ত ওজন কমতে শুরু করে। আমলাকিতে উচ্চমাত্রায় ফাইবার এবং ট্যানিকের মতো অ্যাসিড আছে, যা কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি দেয়। শরীরের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতির ফলে আপনার ওজন দ্রুত কমবে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়: আমলকির অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যাস্ট্রিনজেন্ট বৈশিষ্ট্য রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ক্যান্সারসহ বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদী রোগ অক্সিডেটিভ ক্ষতির কারণে হয়।

যখন দেহের কোষগুলো অক্সিজেন ব্যবহার করে; তখন তারা ফ্রি র্যাডিক্যালস নামে ক্ষতিকারক উপজাতগুলো ফেলে দেয়। আমলকিতে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এজেন্ট আছে। যা এই ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি ঘটায়।

চুল সুন্দর করে: আমলকি পাতার মতো আমলকিও চুলের জন্য কার্যকরী এক টনিক। এটি চুল পড়া বন্ধ করে। খুশকি রোধ করে, চুলের ফলিকেলগুলো শক্তিশালী করে এবং মাথার ত্বকে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়। যার ফলে চুলের বৃদ্ধি ঘটে।

ত্বকের যত্নে: আমলকিতে অ্যান্টি-এজিং বৈশিষ্ট্য আছে। প্রতিদিন সকালে মধুর সঙ্গে আমলকির রস পান করলে দাগহীন, স্বাস্থ্যকর এবং উজ্জ্বল ত্বক পাবেন।

কোলেস্টেরল দূর করে: আমলকি নিয়মিত গ্রহণের ফলে শরীরের খারাপ কোলেস্টেরল দূর হয়। ইনসুলিন উৎপাদন বাড়ায় আমলকি। ফলে ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ কমে। রক্তচাপ বাড়তি হলেও প্রতিদিন সকালে খালি পেটে আমলার রস পান করলে রক্তচাপের স্তর নিয়ন্ত্রণে আসবে দ্রুত।

ব্যথা থেকে মুক্তি দেয়: জয়েন্টে ব্যথা বা আর্থ্রাইটিসের সমস্যায় দুর্দান্ত কাজ করে আমলকি। এর অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য শারীরিক বিভিন্ন প্রদাহ থেকে মুক্তি দেয়।




আমলা কীভাবে খাবেন?


সবচেয়ে বেশি উপকার মিলবে তাজা আমলার রস পান করলে। তবে আমলকির টক ও তেঁতো স্বাদের জন্য যদি রস খেতে না পারেন তাহলে পানির সঙ্গে আমলকির গুঁড়ো মিশিয়ে পান করবেন।

এ ছাড়াও আমলকি কেটে ছোট ছোট টুকরো করে অল্প লবণের সঙ্গে মিশিয়ে রোদে শুকিয়ে রেখে দিন। এটি সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে একটি শুকনো পাত্রে সংরক্ষণ করুন। মুখশুদ্ধি হিসেবে খেতে করতে পারেন এটি।


আমলকির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া-

যদিও গবেষণায় কোনো বিষাক্ত বা, নেতিবাচক প্রভাবের উল্লেখ নেই, তবুও আমলা ব্যবহার সম্পর্কিত কিছু হালকা, প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া রয়েছে।

  • হাইপারঅ্যাসিডিটি ট্রিগার করতে পারে: আপনার যদি হাইপার অ্যাসিডিটি বা ভিটামিন সি খাবারের সংবেদনশীলতা সম্পর্কে কোন ইতিহাস থাকে বা আগে অসুবিধা থেকে থাকে তবে আপনাকে এই ফলটি খাওয়া উচিত নয়।
  • যদি আপনি বেশী পরিমাণে আমলকী খান, তাহলে মোটা হয়ে যেতেন।
  • হাইপারগ্লাইসেমিক মানুষের জন্য পরামর্শ হল যে বীজযুক্ত ফল ব্যবহার এড়াতে কারণ এটি তাদের স্বাস্থ্য অবস্থা খারাপ হতে পারে।
  • আমলকী খাওয়ার ফলে কিছু জনের মধ্যে যে অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় সেগুলি হল ডায়রিয়া, পেট ব্যাথা, পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব, বমিভাব, লবনতা এবং মুখের মুখের চারপাশে ফুসকুড়ি, মুখের লোভ, ত্বকের চামড়া এবং মুখ, শ্বাস প্রশ্বাস। মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা, এবং হালকা অভিজ্ঞতা হতে পারে।

Post a Comment

Previous Post Next Post